পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

বেহাল সংবিধান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ভাবনার সংকট



najmul hudaসংসদ সার্বভৌম। House of the Nation. জনগণের ক্ষমতার প্রতিনিধি-সকল ক্ষমতার উৎস। জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ শুধুমাত্র বাংলাদেশের সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হয়। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট বাংলাদেশের সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বাধীন একটি অ-নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান। জাতীয় সংসদ সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বাধীন একটি সকল ক্ষমতার মালিক জনগনের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান। জনগণের এই প্রতিষ্ঠানই পারে একটি সংবিধান রচনা করতে, সংশোধন করতে ও বাতিল করতে জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে। জনগণের এই ক্ষমতা সুপ্রীমকোর্টকে দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে শুধু সেই আইন বাতিল করার ক্ষমতা যে আইন দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের পরিপন্থী। দেশের সর্বোচ্চ আইনকে পরিবর্তন নয়; সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সুপ্রীমকোর্টকে। সুপ্রীমকোর্টের রায়, বৈধ বা অবৈধ, সংসদের ক্ষমতা খর্ব করার এখতিয়ার রাখে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বর্তমান বিধান আমূল পরিবর্তনের দাবী রাখে। যে ব্যবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দলীয় রাষ্ট্রপতির নিয়োগের সুযোগ রয়েছে, সে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আর যাইই হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় হতে পারে না এবং তদ্রূপ একজন প্রধান উপদেষ্টার অধীন কোনভাবেই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আশা করা যায় না।
রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের উপর বিশ্বাস রেখে যে বিধানের জন্ম সে বিধান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের বেলায়ও যে একইভাবে প্রয়োগ হতে পারে এ বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নাই। এটা অনস্বীকার্য্য যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোন রাজনৈতিক সরকারের অধীন সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয় এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে আপাতত: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিকল্প নাই। তবে যে কারণে এই ব্যবস্থা অপরিহার্য্য সে কারণেই এর আমুল পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। দুর্বল চিত্তের কোন প্রধান বিচারপতি বা বিচারপতি যারা অবসরে যান কর্মক্ষমতা লোপ পাওয়ার কারণে তাদের কাছ থেকে বলিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকা যেমন আশা করা যায় না। অবসরপ্রাপ্ত বিধায় তাদের কৃতকর্মের জবাবদিহিতার প্রশ্নটিও নিরুত্তর রয়ে যায়। এ ধরনের এক দুর্বল ব্যবস্থা নিয়ে পুনরায় কোন পরীক্ষার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে এ ব্যবস্থাকে নাকচ করতে আদালতের আশ্রয় নিতে হবে কেন ? স্বাধীন সার্বভৌম সংসদ কি পারে না এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে? সংবিধানের ১১১ ধারা মতে আপীল ডিভিশনের রায় হাইকোর্ট মানতে বাধ্য — সংসদ নয়। কীভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংক্রান্ত সুপ্রীম কোর্টের রায়ের বাইরে যাওয়ার তাঁর কোন উপায় নেই এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করতেই হবে’? সংসদের ক্ষমতা সম্পর্কে সংসদ নেত্রীর এই ধারণা কেন? এই সংসদ যে সুপ্রীমকোর্টের রায় বাতিল করে আইন করতে পারে সেটা কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অজানা ? বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার স্থলে শত শত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে– সংসদের এই ক্ষমতা যে সুপ্রীমকোর্ট স্পর্শ করতে পারে না, সংসদ নেত্রী তো সেটা ভালভাবেই জানেন। তাহলে কীসের এই বাধ্যবাধকতা?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনার সময় এসেছে। সময় এসেছে একটা শক্তিশালী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা উদ্ভাবনের। সমস্ত জনগণকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান এখন মৃতপ্রায়। ক্ষত-বিক্ষত এই সংবিধানের উপর এত কাটাছেঁড়া হচ্ছে যে এর অস্তিত্ব নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে, বিতর্ক হচ্ছে। বিরোধী দল বলছে, দেশ চলছে সংবিধান ছাড়া আর সরকারী দল বলছে সংবিধান বহাল তবিয়তে রয়েছে। সংবিধান যে বেহাল অবস্থায় রয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। সংবিধানের মৌলিক বিষয়ে চলছে বিতর্ক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ভাষার চেতনা, ধর্মের চেতনা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দলীয়করণ, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ছাত্র রাজনীতি, জঙ্গীবাদ, হরতাল, সন্ত্রাস, আন্দোলন, সংবিধান লংঘন, আদালত অবমাননা, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতিদমন কমিশন, সরকারী কর্মকমিশন — সবকিছু নিয়েই এখন জনগণকে ভাবতে হবে সংবিধানকে যুগোপযোগী করে তুলতে।
দেশের সর্বোচ্চ আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ রেখে, কীভাবে সে আইন এখতিয়ার-বহির্ভূত একটি অবৈধ রায়ের শিকার হতে পারে, সংবিধানের কোন্ বিধানের অধীন আপীল বিভাগ এই এখতিয়ার গ্রহণ করলেন এ সব প্রশ্নের কোন সদুত্তর না পাওয়া পর্যন্ত সংবিধানের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। অবৈধ রায়ে বাতিলকৃত অংশ বাদ দিয়ে সংবিধান পুনঃমুদ্রণ কিংবা বিরোধী দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যাতিরেকে শুধু কিছু চিহ্নিত মহাজোটভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কিংবা বুদ্ধিজীবীর পরামর্শ মতে সংবিধানের উপর সংসদীয় কমিটির Co-chairperson-এর অব্যাহত অস্ত্রপচার সংবিধানকে শুধু পঙ্গুত্বের দিকেই ঠেলে দিতে পারে, সুস্থ্য করে তুলতে পারে না। দেশের সমস্ত ক্ষমতার মালিক জনগণ আর দেশের সংবিধান হচ্ছে সেই জনগনের একটি অঙ্গীকার, একটি ঘোষণা। জনগণের সম্পৃক্ততা ব্যাতিরেকে এই সংবিধানকে স্পর্শ করার এখতিয়ার জনগণ কোন অনির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের হাতে অর্পণ করেনি। শুধু জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদের কাছেই রয়েছে সংবিধান সংশোধনের অধিকার। তাই জনগণকেই আস্থায় নিতে হবে সংবিধানে কোন মৌলিক পরিবর্তন আনতে। সুপ্রীম কোর্টের রায় নয়, জনগণের রায়ই হবে চূড়ান্ত। বিগত নির্বাচনে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের বিষয়ে জনগনের কোন mandate গ্রহণ করা হয় নি – কোন দলের নির্বাচনী manifestoতে এ বিষয়টি প্রতিফলিত হয় নি যার উপর নির্ভর করে সরকারের সংবিধানের উপর বর্তমান কার্যকলাপের বৈধতা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। জনগণকে সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে জনগণের মূল্যবান সম্পদ তথা সংবিধানকে স্পর্শ করার এখতিয়ার জনগণ অন্য কাউকে দেয়নি। এ অবস্থায় সংবিধান নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হলে এ বিষয়ে জনগণের সুচিন্তিত মতামতের প্রতিফলনে গঠিত একটি Constituent Assembly কিংবা গণপরিষদের কোন বিকল্প নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব প্রতিফলিত নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টোর ভিত্তিতে জনগণ তাদের mandate প্রদান করবেন এবং একটি নির্বাচিত গনপরিষদের জন্ম দেবে। এই পরিষদই হবে সংবিধান সংক্রান্ত সমস্ত আলোচনার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু যেখানে নবনির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা বর্তমান সংবিধানের প্রতিটি বিধানের চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংবিধানকে যুগোপযোগী করে তুলবে। গণপরিষদের এই নির্বাচন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে এবং বিতর্ক এড়াতে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মনোনয়ন দিবে বর্তমান সংসদের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষ কমিটি। স্পীকারের নেতৃত্বে এই বিশেষ কমিটির অন্য চারজন সদস্য হবেন সংসদ নেত্রী, সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী, সরকারী দলের চীফহুইপ এবং বিরোধী দলের চীফহুইপ। এই বিশেষ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মনোনীত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেদিন ক্ষমতা গ্রহণ করবেন বিশেষ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক, সেদিন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি বর্তমান সংসদ ভেঙ্গে দেবেন। বিশেষ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মনোনীত এবং সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ০৭ দিনের মধ্যে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন যে কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে গণপরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন করবে। নব নির্বাচিত এই গণপরিষদের মেয়াদ হবে ০৬ মাসের জন্য। এই পরিষদ স্বাধীনতা পরবর্তী এই ৪০ বছরের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্ত অব্যবস্থার অবসান ঘটাবে সর্বোচ্চ আইনের বিধানের মাধ্যমে।
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সুপ্রীমকোর্টের তথাকথিত রায়ের আদলে এখনই কেন, কখনোই বাতিল করতে সংসদ বাধ্য নয়।
গণপরিষদে জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতে এই ব্যবস্থায় ব্যাপক রদবদল এনে যেদিন পর্যন্ত না আমরা সত্যিকার অর্থে নির্বাচন কমিশনকে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করে তুলতে পারি, যেদিন পর্যন্ত না নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব নিয়োগ ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার অধীন সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন পরিচালনায় দক্ষ ও যোগ্য এবং সম্পূর্ণভাবে প্রভাবমুক্ত Cadre গড়ে তুলতে পারি, সেদিন পর্যন্ত নবনির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধানের অংশ হিসাবে এক শক্তিশালী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে দেশের সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দায়িত্ব থাকতে হবে।
প্রয়োজন সদিচ্ছার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার অভাব রয়েছে– জাতি এটি মানতে রাজী নয়। একইভাবে বিরোধী দলের নেত্রীর সদিচ্ছায় ঘাটতি রয়েছে একথাও জাতি মানতে রাজী নয়। শীর্ষ অবস্থানে একের প্রতি অন্যের অশ্রদ্ধাবোধ, পারস্পরিক অসহিঞ্চুতা, দলাদলি, পাল্টাপাল্টি, মুখোমুখি, প্রতিহিংসা ও সংঘাতের অবস্থান থেকে সরে আসা এবং সর্বোপরি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত করে দেশের সার্বিক কল্যাণে নিজেদের নিবেদিত করে বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে একটি সমৃদ্ধ আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে নবজন্মের উন্মেষ ঘটানোই হোক শীর্ষ নেতৃত্বের সদিচ্ছা।
নাজমুল হুদা: সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও যোগাযোগ মন্ত্রী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন